(১)
আমি,‘আহমেদ মাহমুদ দোলন’!আসলে নাম ছিলো.‘মাহমুদ আহম্মদ’!ডাক নাম,‘দোলন’!আমি নিজেই পরে আমার নামটার সংস্কার করেছি!কবির নাম ‘মাহমুদ আহম্মদ ’কেমন যেন আহাম্মকের মত লাগে!সব কবিদের কী সুন্দর সুন্দর নাম!আমি যখন কিছু কবিতা লিখে বেশ নাম করা শুরু করলাম,তখন অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী পিতৃপ্রদত্ত নামটা কিছুটা আগপিছ করে ঠিক করে নিয়েছি!আমি বর্তমানে বাংলাদেশের বেশ বিখ্যাত কবি!কিন্তু হলে কী হবে?বাংলাদেশে আমার জায়গা হলো না!
বছর পাঁচেক যাবৎ কানাডা প্রবাসী!এখনও গা থেকে বাংলার কাদামাটির সোঁদা গন্ধ যায়নি!বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর যতই বসবাসের অযোগ্য হোক,যানজট,লোডশেডিং,পানি-গ্যাসের অভাব,মশার কামড়ে,যে যতই বলুক,‘এ দেশে মানুষ থাকে?’তারপরও ঐ ঢাকার জন্য,ওখানকার বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়-পরিজন,আড্ডা,বাংলাদেশের ভাত-মাছ,নদী-পাখি আর বর্ষার বৃষ্টির জন্য এখনও মন কেঁদে ওঠে!পেটের ধান্ধায় কোনমতে রোজগারের একটা পথ করে নিয়েছি,৮ঘন্টার একটা চাকরি!বাকি সময় ‘বেঙ্গলি টাইমস’,কানাডার একটা অনলাইন পত্রিকা আফিসে বসে কিছু বাংলাদেশি বন্ধুবান্ধবের সাথে লেখালেখির চর্চা আর আড্ডায় সময় কাটাই!সামনে পি.সি.-তে ফেসবুক খুলে রাখি,ঢাকার কাউকে দেখলে আড্ডায় জমে যাই!ঘরে ফিরে রাত জেগে লেখালেখি করি!কবিতা লেখা ছেড়ে ,এখন তীব্র জ্বালাময়ী ভাষায় প্রবন্ধ লিখি,সেগুলো কানাডা ও বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়!মাঝে মাঝে বাংলাদেশ,ভারত থেকে কবি-সাহিত্যিক,গায়ক-নায়ক এলে হৈচৈ করে অনুষ্ঠান করি!আর বাকি সময় নিস্তরঙ্গ জীবন!
এইসময় একদিন ‘বেঙ্গলি টাইমস’ এর আফিসে বন্ধুবান্ধব সমেত বসে আছি,যথারীতি ফেসবুক খোলা!বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে!হঠাৎ ঝন্টু ছোটখাটো একটা চিৎকার দিয়ে,আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে,ল্যাপটপে একটা ছবির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালো!
আমরা সবাই ঐ ছবির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে অভিভ্থত হয়ে গেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম।জরিপাড় তাঁতের শাড়ি পরা,কপালে ছোট্ট টিপ,বড় বড় চোখ,আঁকা ভুরু,একঢাল কালো চুল আর মুখে হাসি নিয়ে ,দেবীর মতো এক তরুণী আমাদেও দিকে তাকিয়ে আছে!লাবণ্য যেন ঝেও ঝেও পড়ছে!এই মেয়ে নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী!নাম,‘সোফিয়া লিসা’!ধন্ধে পড়ে গেলাম,সুফিয়া না হয়ে ‘সোফিয়া’!বিদেশিনী নয়তো?শাড়ি পরা দেখে বাঙ্গালি ভেবেছি!তাড়াতাড়ি ইনফো চেক করে আশ্্বস্ত হলাম,মেয়েটি বাঙালি ।কিন্তু বয়সের সাথে ছবির বয়স মিলছে না,প্রায় ১০বছরের পার্থক্য তো হবেই!ভাবলাম,হয়তো পুরনো ছবি দিয়েছে!অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাাগলাম!প্রায় ৩দিন পর দেখলাম,তরুণী আমাদেও সবাইকে ফেন্ড হিসেবে কনফার্ম করেছে।আমরা তাকে অনলাইন দেখার অপেক্ষায় রইলাম।রোজই তার ওয়াল পোস্টে কিছু লেখা আছে কিনা খুঁজি।এরই মাঝে আমাদেও এক বন্ধু তার ওয়ালে লিখেছে,‘বহুদিন পর এমন সুন্দর এক পবিত্র মুখ দেখলাম!একেবারে মনে হচ্ছে দেবী!তোমায় পূজা করি!’আমরা হাহাহা কেও হাসি!
এর প্রায় এক সপ্তাহ পরে দেখলাম,মেয়েটি আমার ওয়ালে পোস্ট দিয়ে লিখেছে,‘আপনার বাড়ি কি ময়মনসিংহের শেরপুরের চন্দ্রকোণার,বাছুর আগলা গ্রামে?’
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম!হৃৎপিন্ডের লাফালাফির শব্দ শুনতে পেলাম!এই মেয়ে আমাকে চেনে কীভাবে?এতো সুন্দরী একটা মেয়ে আমার পূর্ব পরিচিত হলে আমি চিনতে পারতাম না,তাই কি হয়?তাছাড়া আমার অতি নিকট বন্ধুবান্ধবও আমার গ্রামের নাম জানেনা?এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি. গ্রামের স্কুল কলেজ থেকে পাশ করে,সেই অনেক বছর আগে আমরা পুরো পরিবার ঢাকায় চলে এসেছি।তারপর দেশে থাকতে কবি হিসেবে বইপত্র বের হলেও ফ্ল্যাপে বা পরিচিতিতে কোথাও আমার গ্রামের নাম লিখিনি!শেরপুর বর্তমানে জেলা শহর কিন্তু আমার জন্মের সময় এটা ছিলো ময়মনসিংহ জেলার অন্্তর্গত।আমার জন্মস্থান ময়মনসিংহ বলেই সবাই জানে,গ্রামের নাম-ধাম কেউ জানেনা।ইনফোতে লেখা,হোমটাউন-ঢাকা।
আমি কাঁপা হাতে উত্তরে লিখি,‘জি,আপনি জানলেন কী করে?’
ঠিক ঐ সময় মেয়েটিকে অনলাইন দেখা েেগলো!সে আমাকে নক করলো,‘হাই!’
আমি লিখলাম,‘জি!’
‘আরে দুলু!জি জি করছো কেন?আমি কি তোমার বস?কেমন আছো?’
আমি চমকে থমকে গেলাম!এই তরুণী আমার ডাক নামও জানে!আমতা আমতা কেও লিখি,‘জি ভালো।’
‘আবারও জি! আশ্চর্য!তোমার সব খবর বল।এখনও কবিতা লিখো না কি?’
আমি ঢোঁক গিলে আবারও লিখি,‘জি না!’
মেয়েটি হঠাৎ করেই আর কিছু না বলেই লগ-আউট করে!তারপর থেকে অপেক্ষা করেও তাকে আর অনলাইন দেখতে পাইনা!তবে প্রিিতদিনই আমা্র কাছে ওর মেসেজ আসতে শুরু করে আর আমি প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে ওগুলো পড়তে থাকি!কিন্তু মেয়েটিকে আমি চিনতে পারিনা কিছুতেই!অত রূপবতী একটি মেয়েকে আমি ভুলে যাবো?এতো স্মৃতিশক্তিহীন নিজেকে ভাবতে পারিনা!আমি কবি ঠিকই,কিন্তু আমার লেখার মাঝেই যত রোমান্টিকতা!আমার বাস্তব জীবন আতি সাধারন।কারোর প্রেমে পড়িনি,কারণ কেউই আমার প্রেমে পেেড়নি।সেসময় কবি-সাহিত্যিকদের টাকাপয়সা ছিলো না।মেয়েরা সচরাচর তাদের প্রেমে পড়লেও ঐ পর্যন্তই,বিয়ে-টিয়ে করতো না।আজকাল অবস্থা পালটেছে,সবাই অলরাউন্ডার!যিনি কবিতা লিখছেন,তিনি গল্প-উপন্যাস থেকে শুরু করে গান, নাটক,চিত্রনাট্যও লিখছেন!এমনকি নাটক,সিনেমাও বানাচ্ছেন!কোন কোন কবি তো আবার বিরাট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট!এখন আর কবি-লেখকরা সেই গরিবের দলে পড়েনা!সেসময় যদি এরকম সুবিধা থাকতো,তবে আমাকে আর দেশ ছেড়ে আসতে হতো না।সেদিন দেখলাম আমার ওয়ালে একজন পোস্ট দিয়েছে,‘ঔপন্যাসিকের ব্যাঙ্কে টাকা,
কবির পকেট ফাঁকা!’
আমি সবিনয়ে ্উত্তর দিয়েছি,‘আমি আর এখন কবি নেই ভাই!’আসলেই কবিতা লেখা আর হয়ে ওঠেনা!ঝন্টুর চাপাচাপিতে কিছু প্রবন্ধ লিখি।
সেদিন দেখলাম গুণ-দার (কবি নির্মলেন্দু গুণ) ওয়ালে একজন লিখেছে,
‘হুমায়ূনের নুহাশ পল্লী
টাকা-কড়ি কাঁড়ি কাঁড়ি,
নির্মলেন্দুর পকেট খালি
সম্বল কেবল লম্বা দাঁড়ি!’
গুণ-দা কমেন্ট করেছেন,‘গুড কম্পোজিশন!’
গুণ-দার বেলায় এ কথা খাটেনা।তিনি মোটামুটি টাকাপয়সার মালিক,তবে এটাও তার গদ্য লেখার গুণে!
লিসার মেসেজ আসছে জলসো্রতের মতো!পুরো লিখতে গেলে একটা ১০ফর্মার উপন্যাস হয়ে যাবে!আমি শুধু সারাংশগুলো তুলে ধরছি।লিসা লিখেছে:
দুলু,(কোন প্রিয় ট্রিয় নেই),
এই তোমার জন্য দুলু,শুধু তোমর জন্য আমি জীবনে হ্যাপি হতে পারলাম না(লাইনটা পড়ে প্রচন্ড মন খারাপ হয়ে গেলো!)!মেডিকেল কলেজের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট,স্মার্ট,হ্যান্ডসাম আর রিচ ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে হলো আমার।এমন স্বামী পাওয়া প্রতিটি মেয়ের জন্য ভাগ্যের ব্যাপার!অথচ আমি মেনে নিতে পারলাম না!বিয়ের সময় একবার ভয়ে ভয়ে তোমার নাম বলেছিলাম!আমার রাশভারী বাবা বললেন,‘না’!
ব্যস,সব চুকে বুকে গেলো।আমার আর সাহস হয়নি প্রতিবাদ,প্রতিরোধ করার!আসলে বাবার মত দেবার কথাও নয়!তোমার আমার সামািিজক,অর্থনৈতিক সব অবস্থানই ছিলো আকাশ-পাতাল ফারাক!তুমি এক গ্রামের দরিদ্র স্কুল শিক্ষকের ছেলে,গ্রামেই জন্ম তোমার,ওখানেই বড় হয়ে ওঠা,ওখানকার অনামী,অখ্যাত স্কুলের ছাত্র!আর আমি শহরে প্রতিপালিত,বিরাট ধনী পরিবারের,ডাকসাইটে অফিসারের সুন্দরী কন্যা!মংমনসিংহের সবচেয়ে অভিজাত নামী স্কুলের মেধাবী ছাত্রী!জীবনে ক্লাশে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হইনি(সিনেমার নায়কের মত না,সত্যি)!এ.এস.সি-তে ঢাকা বোর্ডে মেধাতালিকায় ৩য় স্থান অধিকার করলাম।সারা শহরের লোক ভেঙে পড়লো আমাদের বাসায় ,আমাকে একনজর দেখার জন্য!সেসময় বাবার আনন্দে ঝলমল গর্বিত মুখের কথা কোনদিনই ভুলিনি আমি!এইচ.এস.সি-তেও একই অবস্থা,ঢাকা বোর্ডে ২য় স্থান!
আমি কি নিজেও কিছুটা অহঙ্কারী ছিলাম না?শুধু এক জায়গায় এগিয়ে ছিলে তুমি,কবিতা লেখায়!আমার মনে হতো,এখানেও আমি হার মানবো না!আমিও লেখালেখি শুরু করলাম।পত্রপত্রিকায় আমার লেখা ছাপাও হতে লাগলো!আমার বন্ধুবান্ধবরা আমাকে আলাদা নজরে দেখতো,সমীহ তো করতো আগে থেকেই্!এইচ.এস.সি-র পর আমি চাইলাম বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়বো!চাচা,মামা,আত্মীয়-বন্ধুরা আকাশ থেকে পড়লো!
‘এতো ভালো রেজাল্ট নিয়ে কেউ বাংলায় পড়ে?তুই পড়বি মেডিকেলে!’
আমার কবি মামা বললেন(যার ওপর আমি একটু ভরসা করেছিলাম যে তিনি আমার পক্ষে কথা বলবেন),‘যার রেজাল্ট ফেলের কেরিক্যাচার,সে পড়ে বাংলা লিটেরেচার!দেখছিস না আমার অবস্থা?’মামা কোন ফেল্টু মার্কা ছাত্র ছিলেন না,যথেষ্ঠ ব্রিলিয়্যান্ট!আমি মামার কোন খারাপ অবস্থা দেখলাম না!দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে,আড্ডা দিচ্ছে,ঘুমাচ্ছে,আর কবিতা লিখে বেড়াচ্ছে!আনন্দময় জীবন!কিন্তু আমার েেবলায় সবাই বাদ সাধলো!
বাবা বললেন,‘আমিও ইংরেজি সাহিত্যেও ছাত্র।লিটারেচার যদি পড়তেই চাও,ইংরেজি পড়,বাংলা কেন?’
আমিও বাবার মত গম্ভীর হয়ে বললাম,‘না!’
ভর্তি হলাম মেডিকেলেই!কবিতা পড়া,লেখালেখিকে গুডবাই জানালাম।তোমার সাথেও যোগাযোগ শেষ!আসলে আমি বাংলা নিয়ে ভার্সিটিতে পড়তে চাইছিলাম শুধু তোমার জন্য,যাতে তোমার সাথে সবসময় দেখা হয়।হলো না তো!আমি অপেক্ষায় ছিলাম লেখাপড়া শেষ হোক,তখন বলা যাবে তোমার কথা।বিয়ের সময় বললামও তো!কিন্তু কী হলো?
বাবার ওপর অভিমান হয়,ভাবি তার জন্যই আজ আমার এ অবস্থা!আমার টাকাপয়সা,বাড়ি-গাড়ি,আরাম-আয়েস,বিলাস-ব্যসন কোন কিছুর অভাব নেই!শুধু দু’টো জিনিষের অভাব,এক ভালোবাসা,দুই স্বাধীনতা!বিয়ের পর পরই আমার স্বামী জেনে গিয়েছিলো তোমার কথা!আমিও অস্বীকার করিনি কোন কিছু!তারপর থেকেই আমি বন্দিনী রাজকন্যা!আজ দীর্ঘ ১০বছর আমি এই বাড়িতে বন্দি জীবনযাপন করছি!আমার প্রফেসন চালিয়ে যাওয়া,বাইরে যাওয়া,কারো সাথে দেখা করা,কথা বলার অনুমতি নেই আমার!এই পৃথিবীর আলো-হাওয়া,আকাশ-বাতাস,মাটি-পাহাড়,নদী-সমুদ্র সব,সব আমার জন্য নিষিদ্ধ!ভালোবাসাহীন পরাধীন জীবনে আমি যে বেঁচে আছি এটাই তো চরম বিস্ময়!বাবা যদি সে সময় তোমার সাথে বিয়েটা দিতে রাজি হতেন,তাহলে তো আজ আমি এমন অসুখি জীবনযাপন করতাম না!তোমায় নিয়ে সুখি হোতাম।নাইবা থাকতো অর্থ-বিত্ত,প্রভাব-প্রতিপত্তি,আরাম-আয়েস,ভালোবাসা তো থাকতো?আমার যখন খুব কষ্ট হয়,তখন তোমার কাছে চলে যেতে ইচ্ছে কেও দুলু!বাবার জন্যই এমন হলো।বাবার কথা বলি তোমায়...
বাবা ছিলেন সে সময়কার ডাকসাইটে অফিসার।ময়মনসিংহের ডি.এম(ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট)।আমাদের বাসাটা ছিলো ব্রহ্মপুত্র নদের পারে।সরকারি রিক্যুইজিশান,প্রায় ৫বিঘার ওপর বিশাল পুরনো জমিদার বাড়ি!ছাদে দাড়িয়ে নদীর পানি,নৌকা,লোকজন সবই দেখা যেতো!আমাদেও খেলাধুলা,বেড়ানো সবই এই নদীর পারে।আমাদের বাসার ৪টা বাড়ির পরই ছিলো তোমার আত্মীয় জাফর খালুর বাড়ি।ছোটবেলায় খুব যেতাম ঐ বাড়িতে।বড় হওয়ার পর শুধু তুমি এসেছো ,খবর পেলেই যেতাম!জাফর খালুর এক বিধাব বোন থাকতেন ঐ বাড়িতে,তাকেও আমরা খালাম্মা ডাকতাম।
খালাম্মা আমাকে দেখলেই বলতেন,‘কী রে লিসা,তুই তো এদিকে এখন আসিসই না!শুধু দুলু এলেই তোকে দেখা যায়!ব্যাপার কী রে,দুলুকে পছন্দ হয়?বিয়ে করবি ওকে?’
আমি মাথা নিচু করে থাকি।খালাম্মা আবার বলেন,‘কিন্তু তোর বাবা তো এই বিয়ে দেবে না রে?কত্ত বড় আফিসার আার তোরা কত বড়লোক!তুই ও তো দেখতে রাজকন্যা,তারওপর বেশি ভালো ছাত্রী!না রে,আমাদেও মতো গরিবের সাথে আত্মীয়তা করবেনা তোর বাবা!’
আমি মুখ নিচু করেই বলতাম,‘হুঁ ,বলছে তোমাকে!’
তারপর ছুট লাগাতাম তোমার খোঁজে,দুলু!বাগানে গেটের পাশে দু’দিকে দু’টি গাছ,একটি অশোক,আরেকটি কাঞ্চন!তোমার সাথে বেশিরভাগ সময় দেখা হতো অশোক গাছের তলায়।
আমি তোমাকে চমকে দিয়ে বলতাম,‘এই দুলু,কী করছো এখানে?কবিতা লিখছো বুঝি?দেখি,দেখি কী লিখলে?’
তুমি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে,‘কীসের কবিতা?যেখানে সেখানে কবিতা লিখতে পারিনা আমি!’
আমি হাসতে হাসতে বলতাম,‘তো তুমি কীসের কবি?আমি তো নদীর পারে বসেও দিব্যি লিখতে পারি!’
তুমি বিরক্তি নিয়ে বলতে,‘সবাইকে সব কিছু পারতে হবে নাকি?তুমি পারো,আমি পারিনা।আমি তোমার মত ব্রিলিয়্যানট তো নই?’
তারপর শুরু হতো খুনসুটি!কখনো তুমি বসে থাকতে কাঞ্চন গাছের তলায়,সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চে।আমি পেছন থেকে গিয়ে তোমার চুল টেনে দিয়ে,টুপ করে লুকিয়ে বেঞ্চের পেছনে বসে পড়তাম!
তুমি ‘উহ্’ শব্দ কেও চারদিকে তাকিয়ে বলতে,‘বুঝেছি,বেরিয়ে এসো এবার,এসো সামনে!’
আমি খিলখিল হাসিতে চারদিক উচ্চকিত করে সামনে এস বলতাম,‘এই দুলু,গাছে উঠে ফুল পেড়ে দাও তো!জানো কাঞ্চন ফুলে খুব মজার পাকোড়া হয়?খাওয়াবো তোমাকে!’
তুমি বলতে,‘আমি গাছে চড়তে পারবো না,যাও এখান থেকে!পাকোড়া তুমি খাওগে!’
আমি দ্রুত কাঠবেড়ালির মতো তড়তড়িয়ে গাছে উঠে যেতাম!তারপর ডালপাতা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে,তোমার মাথা,শরীর ফুল পাতায় ভরে দিতাম!
দুলু,এসব মনে আছে তোমার?আমি যে কিছুই ভুলিনি,ভুলতে পারিনা!খালাম্মার কথাই ঠিক হলো,বাবা মত দিলেন না!আমিও চুপ করে গেলাম!হঠাৎ করেই আমার মনে হয়েছিলো,বিয়েতে প্রেম-ভালোবাসা মরে যায়!প্রেমিক-প্রেমিকা বিয়ের পর শুধুই স্বামী স্ত্রী বনে যায়,প্রেম আর থাকেনা!বিখ্যাত সব প্রেমের ইতিহাস তো শুধুই বিরহ-বিচ্ছেদ!স্ত্রী কখনো প্রিয়া হয়না!আমার মনে হয়েছিলো বিরহেই তোমাকে সত্যিকারভাবে পাওয়া হবে!এখন মনে হয়,এ কে বিরাট ভুল!তখন যদি একটু জেদ করতাম,তাহলে হয়তো বা বাবা আমার কথা মেনে নিতেন।তোমাকে হারাতে হতো না!আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেতো না।এখন যে আমার শুধু তোমার কছে চলে আসতে ইচ্ছে করে দুলু!এ জীবনে তো তোমাকে পেলাম না!আমাদের ধর্মে পুনরজন্ম নেই,কিন্তু মৃত্যুর পরের জীবন তো আছে।সেই পরজনমে গড-এর কাছে তোমাকে চাইবো।নিশ্চয় দেবেন তিনি।জীবনে জানামতে আমি কোন পাপ করিনি,শুধু তোমাকে ভালোবাসা ছাড়া!অবশ্য ভালোবাসা যদি পাপ হয়।ভালোবাসা কি পাপ?আমি আজও ভালোবাসি তোমায়,ভালোবেসেই যাবো অনন্তকাল,জন্মজন্মান্তর ভালোবাসবো...!আমি এতাগুলো বছর কেঁদেছি তোমার জন্য!জীবনের বাকি কয়টা দিনই শুধু নয়,‘জনম জনম তব তরে কাঁদিবো...!
(২)
রোজ লিসার মেসেজ আসছে!আমার মাঝে কেমন একটা অস্থিরতা চলে এসেছে!আমি খেতে পারছি না,ঘুমুতে পারছি না,কাজে মন বসাতে পারছি না!বেঙ্গলি টাইমসে যাওয়া বন্ধ,কোন আড্ডায়ও যাচ্ছি না!বন্ধুবান্ধবরা ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে,‘কী হয়েছে?আমি ঘরে বসে আছি কেন?’ঝন্টু রেগে গিয়ে বললো,‘কবে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে লেখার কথা,কোন খবরই নেই!’আমি াঅ্যাভয়েড করছি সবাইকে!আমি একটা ঘোরের মাঝে আছি!প্রবল আগ্রহ নিয়ে লিসার মেসেজের অপেক্ষায় থাকি!আমার পৃথিবীটা লিসাময় হয়ে গেছে!আমি এখানে লিসার প্রেমিকা।আমার বারবার খুব আফসোস হচ্ছে,লিসার সাথে আমার ময়মনসিংহের অধ্যাযটি কীভাবে ভুলে গেলাম!একদম কমপ্লিপ ব্ল্যাক-আউট!কিছুতেই মনে করতে পারিনা আমি!
আমার হোম ডিস্ট্রিক্ট ময়মনসিংহ হলেও ওখানে গেছি মাত্র ৩বার!একবার একটি সাহিত্য সম্মেলনে,একবার তসলীমা নাসরিনের বাড়িতে আর একবার বন্ধুদের সাথে ব্রহ্মপুত্র পারে!লিসার বাসা ব্রহ্মপুত্র পাওে,তসলীমার বাসার কাছেই,তবে কি ওখানেই দেখা হয়েছে?কই ,মনে পড়ছে না কেন?
ঘোরের মাঝেই আমি দেখতে পাই,লিসার হাত ধরে নদীর চরে হেঁটে বেড়াচ্ছি,পানিতে পা ডুবাচ্ছি!কাশবনে লিসার ছুটে বেড়ানো দেখি!অশোক আর কাঞ্চন তলায় দু’জন মুখোমুখি বসে আছি!আমার জীবন লিসা ছাড়া অর্থহীন!
এভাবে প্রায় ৩মাস হতে চললো!আজ বাংলাদেশে ঈদ!কানাডায় ঈদের দিনেও আমরা কোন ছুটি পাইনা,কাজে যেতে হয়! কানাডায় এখন রাত ১১টা,বাংলাদেশে সকাল ৯টা।এসময়ই ফেনটা এলো!রিসিভার তুলে,‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশের Kɯ^i শুনতে পেলাম!
‘হ্যালো,ঈদ মোবারক!আমি লিসা বলছি।আমি কি দুলুর সাথে কথা বলছি?’
এমন অপূর্ব Kɯ^i আমি আমার জীবনে এর আগে কখনও শুনিনি!আমার শরীর কাঁপতে লাগলো,বুকের ভেতর সুখের পাখির ছটফটানি,গলা কাঁপছে!কোনমতে ঢোক গিলে বললাম,‘জি!’
আমি অভিভ্থত,অবশ হয়ে যাচ্ছে আমার সমস্ত সত্ত্বা!রিসিভার শক্ত করে কানের কাছে ধরে আছি!মেেন হচ্ছে এটা হাত থেকে পড়ে গেলে,লিসা হারিয়ে যাবে!আমি সমস্ত মন দিয়ে,প্রাণ দিয়ে,ওপারের কথাগুলো শুনে যাচ্ছি!
লিসা বলছে,‘আমি েেতামাকে সেই ছ্োটবেলা থেকে চিনি!তুমি বোধহয় আমাকে চিনতে পারোনি।অবশ্য না পারারই কথা।’
আমার কণ্ঠ রোধ হয়ে গেছে!মনে মনে উচ্চারন করি,‘না,না,আমিও তোমাকে চিনি।সবই মনে আছে আমার!কেন চিনতে পারবো না?’
লিসা বলেই চলেছে,‘তোমার সাথে আমার কখনও দেখা হয়নি দুলু!তোমার আর আমার বাড়ি একই গ্রামে।আমরা তো গ্রামে থাকিনি কখনও,ময়মনসিংহ শহরে থেকেছি!মাঝে মাঝে ছুটি ছাটায় যাওয়া হতো গ্রামে!তোমাদের বাড়িতে যেতাম,শুনতাম তোমার কথা!তুমি নাকি ভালো ছাত্র,ভালো কবিতা লেখো!তোমার ছবি দেখতাম,তোমার একটা ছবি একবার আমি নিয়েও এসেছি,সেটা এখনও আছে আমার কাছে!তোমার প্রতিটি কবিতা,যেগুলো পেপারে ছাপা হতো,পড়ে কেটে রেখে দিতাম!তোমার সব বই আছে আমার কাছে!’
লিসা হাসছে!হাসতে হাসতে বললো,‘জানো,তুমি কবিতা লেখো শুনে আমিও লেখার চেষ্টা করতাম কিন্তু ওগুলো কবিতা হতো না!তারপর শুরু করলাম গল্প লেখা!এটাতে মনে হয় সফলকাম হয়েছি!এবারের প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় আমার লেখা উপন্যাস ‘জনম জনম তবে তরে কাঁদিব’ ছাপা হয়েছে!রোজ যতটুকু লিখেছি তার স্ক্রিপ্ট তোমাকে পাঠিয়েছি,তুমি কমেন্টস করবে বলে!কিন্তু তুমি এখনও কোন কমেন্টস করনি!এখনতো পুরো উপন্যাসটি একবারে পড়তে পারবে!এখন কিন্তু এটার রিভিউ তুমি লিখে সব পত্রপত্রিকায় দেবে!তুমি বিখ্যাত কবি-লেখক,তুমি যা লিখবে তাই গুরুত্ব নিয়ে ছাপা হবে!আমি ঈদ সংখ্যাটি পাঠিয়ে দেবো।ওহ্,ভালো কথা,আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি,তাই আমার নায়কের নাম দিয়েছি ‘দুলু’!তুমি যেন আবার কিছু মনে করোনা!তোমার পোস্টাল অ্যাড্রেসটা...?’
আমি নির্বাক,নিঃশব্দ দাঁড়িয়েই আছি!কথা বলতে পারছি না!হঠাৎ করে মনে হলো স্বর্গ থেকে ভূপাতিত হয়েছি!নক্ষত্রের পতন!ছোটবেলায় উল্কাপতন দেখতাম!মা বলতেন,‘এগুলো হলো আকাশের তারা।শয়তানকে শায়েস্তা করতে আল্লাহ তারাকে হুকুম দেন,‘তাড়া’!এই ‘তাড়া’ থেকেই নাম হয়েছে,‘তারা’!সেজন্যই শয়তানের পিছু পিছু আকাশ থেকে ধাওয়া করে পৃথিবীতে ছুটে আসে ‘তারা’!’
আমরা এই উল্কার পতন দেখেছি,কোথায় পড়লো খুঁজে বের করেছি!দেখেছি,একটা লৌহশলাকা পুড়ে কালো কুচকুচে কয়লার মত হয়ে পড়ে আছে!
আমার পৃথিবীটা হঠাৎ করে থমকে গেলো!উল্কাপতনের লৌহদন্ডের মত আমার জগৎ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেলো!এর মাঝেও আমি চোখ খুলে লিসাকে দেখতে পেলাম!---
আমি আর লিসা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছি অশোক গাছের তলায়!টুপটাপ করে অশোকের লাল লাল মঞ্জুরি দু’জনের মাথায় পড়ছে তারপর গা বেয়ে নিচের সবুজ ঘাসে স্ত্থপ স্ত্থপ রক্তের মত জমা হয়ে আছে!এ যেন আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ!
ওপাশের কণ্ঠস্বর কখন জানি থেমে গেছে!মহাকালের মত আমি দাঁড়িয়েই আছি রিসিভার হাতে!বাইরে ঝুম বৃষ্টি!সেই বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে,আমার দু’চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে!লিসাকে যেদিন প্রথম ফেসবুকে আবিস্কার করি,সেদিনও এমনি বৃষ্টি ছিলো!এতোক্ষন পর আমি ফিসফিস করে বললাম,লিসা,আমি তোমায় ভালোবাসি!ভালোবেসেই যাবো অনন্তকাল,জন্ম জন্মান্তর ভালোবাসবো!আর আমার কান্নার শুরু,কখনও শেষ হবে না এ কান্না!জনম জনম তব তরে কাঁদিব…!